RSS

Category Archives: রাজনীতি

রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বাধীনতা

আজাদি একটি বিশাল নিয়ামত এবং জীবনের অনিবার্য প্রয়োজন। এর জন্য যে ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করা হবে সেটাও ব্যাপক সমাদৃত। আমাদের ওইসব পথপ্রদর্শকেরও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে এ কথা আরজ করতে চাই, যে সিদ্ধান্ত ও শক্তির বদৌলতে আমরা গোলামির অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছি, সেই সিদ্ধান্ত এবং শক্তিকে যদি এর চেয়েও বাস্তবিক ও পূর্ণাঙ্গ আজাদি অর্থাত্ মানবিকতা গঠন ও উন্নয়ন এবং মানুষকে মানুষ বানানোর কাজে ব্যয় করি, তবে এটি হবে দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, সমস্যা এবং সঙ্কটের চিরস্থায়ী সমাধান।
আমি আজাদি আন্দোলনের প্রতি অবজ্ঞা বা না-শোকরি করছি না, তবে এটা না বলেও পারছি না যে, দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং মানবতার সবচেয়ে বড় খেদমত হচ্ছে, মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে যাওয়া। এছাড়া স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের পরও জীবনের প্রকৃত তাত্পর্য, প্রশস্তি এবং স্বচ্ছন্দ হাসিল হয় না। বিক্ষিপ্ততা, টানাপড়েন এবং অস্বস্তি দূর হয় না। বিপদাপদ, ব্যতিব্যস্ততা ও অপমান শুধু অন্যের আকৃতিতেই আসে না, কখনও নিজের থেকেই এর স্ফুরণ ঘটে। জুুলুম-নির্যাতন ও লুটতরাজের জন্য ভিনদেশি হওয়া শর্ত নয়। একই দেশে অবস্থানকারী দ্বারা কখনও এ কাজ সংঘটিত হতে পারে। গোলামির প্রতি ঘৃণা আমারও কম নয়। কিন্তু আবেগ ও মোহ থেকে আলাদা হয়ে একটু চিন্তা করুন! আমরা ইংরেজদের কেন শত্রু মনে করতাম? গোলামির প্রতি আমাদের ঘৃণা কেন ছিল? এজন্য যে, জীবনের প্রকৃত তাত্পর্য আমাদের সহায়ক ছিল না। আমাদের কোনো স্বস্তি ছিল না। জীবনের প্রয়োজন পূরণ সহজসাধ্য ছিল না। আমরা সহমর্মিতা, একনিষ্ঠতা, সহযোগিতাবোধ এবং প্রেম-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলাম, যাতে অতীত জীবন হয় তিক্ত এবং এ দুনিয়ার জেলখানাসদৃশ। মনে করুন! যদি বাইরের গোলামির অবসান ঘটে কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যেই একে অপরকে গোলাম বানানোর প্রবণতা চালু হয়ে গেল। আমাদের পরস্পরে জুলুমের স্বাদ অনুভূত হতে লাগল। আমরাও একে অন্যের অপরিচিত, অজ্ঞাত। সহযোগিতা ও সহমর্মিতা থেকে অনেক দূরে। এক শহরের লোক অন্য শহরের লোকের সঙ্গে এমন আচরণ করতেই উদ্বুদ্ধ হচ্ছি, শুধু সুযোগের প্রত্যাশায় আছি, যা বিজয়ী গোলামের সঙ্গে এবং শত্রুর সঙ্গে করে। আমরা আমাদের সঞ্চিত সম্পদে অন্যের অপরিহার্য প্রয়োজনীয় সম্পদটুকু ঢুকিয়ে দেয়ার পাঁয়তারায় লিপ্ত। এ ধরনের মানসিকতা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। কোরআনে কারিম এটাকে একটি ঘটনার দ্বারা বিবৃত করেছে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, হজরত দাউদের (আ.) কাছে দুপক্ষ মোকদ্দমা নিয়ে এলো। একজনে বলল, হে আল্লাহর নবী! হে বাদশা! আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের প্রতি একটু ইনসাফ করুন। আমার এ ভাইয়ের কাছে ৯৯টি ভেড়া আছে, আমার আছে মাত্র একটি ভেড়া। কিন্তু এই জালেম বলছে, আমি যেন তাকে আমার ভেড়াটিও দিয়ে দিই, তবে তার শত পুরো হবে। আমি আপনার কাছে জানতে চাই, যদি কোনো রাষ্ট্রে বা শহরে এ ধরনের মনোভাবের প্রসার ঘটে, তবে কি স্বাধীনতার প্রকৃত সম্পদ সেখানে বাস্তবে রক্ষিত আছে? বিষয়টি কি এমন নয় যে, উপনিবেশগোষ্ঠী যে আচরণ করত সেটাই স্বজাতি, প্রতিবেশীর দ্বারা করা হচ্ছে। পরাধীনতার সব শৃঙ্খলই কি এখানে কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান নয়? এসব কিছু এজন্য যে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য প্রাণপণে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের মন-মগজ এবং তার আত্মার প্রশস্তির জন্য কোনো চেষ্টা করা হয়নি। ফলে সেগুলো যথারীতি গোলামই রয়ে গেছে। দেশ থেকে জালেম বিতাড়িত করা হয়েছে, কিন্তু দিল থেকে জুলুমের বাসনা নির্মূল করা হয়নি। সেটি বহাল আছে এবং নিজের কাজ করে যাচ্ছে।
নবী-রাসুলরা আল্লাহপ্রদত্ত সব শক্তি এবং নিজেদের পুরো মনোযোগ ব্যয় করেছেন প্রকৃত অর্থে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরির কাজে। তারা শুধু রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাকে নিজেদের দৃষ্টিভূত করেননি। বরং অনুভূতির জ্বলন তৈরি, ঈমান-আকিদাকে মন-মগজে সুদৃঢ়করণ এবং ওই আখলাক সৃষ্টির প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়েছেন, যাতে উপনিবেশ ও অভ্যন্তরীণ কোনো দাসত্বেরই সুযোগ ছিল না। যার কারণে মানুষ অন্যের গোলামিও বরদাশত করত না এবং অন্যের ওপর নিজের গোলাম আরোপ করার মনোবাসনাও পোষণ করত না, যার ফলে অন্যের শিকারেও পরিণত হতো না আবার অন্যকেও নিজেদের শিকারে পরিণত করত না। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহের (সা.) দৃষ্টান্ত দেখুন! তাঁর পাশে আত্মত্যাগী, উত্সর্গকারী যে বিশাল জামাত জড়ো হয়েছিলেন তাদের দ্বারা তিনি যে কোনো কাজ আঞ্জাম দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাদের চারিত্রিক উত্কর্ষ ও মানবিকতা উন্নয়নে তাঁর সব সামর্থ্য ব্যয় করেছেন। তিনি মানবতাকে এমন কোনো চোখ ধাঁধানো আবিষ্কার কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি দেননি ইউরোপের বিজ্ঞানীরা, যা এ যুগে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী [রাজিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম আজমাঈন]-এর মতো কিছু মানুষ তৈরি করে গেছেন যারা মানবতার জন্য রহমত ও বরকতের ভাণ্ডার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন। আজও যদি মানবতাকে প্রশ্ন করা হয়, তারা শাসনকর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের জন্য আবু বকরের (রা.) মতো মানুষ চায় নাকি সর্বাধুনিক আবিষ্কারগুলো হাতের নাগালে চায়। নিশ্চয় তাদের কাছ থেকে উত্তর আসবেআবু বকরের (রা.) মতো মানুষই তাদের বেশি প্রয়োজন। কেননা তারা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি এবং আবিষ্কারগুলো ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করে দেখছে, প্রকৃত মানুষের অবর্তমানে এসব দুনিয়ার জন্য মসিবত ও ধ্বংসের বার্তাবাহক।
আমি বারবার বলেছি এবং বলব, সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষ বানাতে হবে। তখন তার মধ্যে গোনাহ ও জুলুমের বাসনা নির্মূল হবে, নেক ও খেদমতের জযবা সৃষ্টি হবে। মানুষের জীবনধারায় হাজারো প্রতিকূলতা সৃষ্টি হয়, মানবিক জীবনে অসংখ্য সমস্যা ও সঙ্কট দেখা দেয়, ভারি ভারি তালা পড়ে, আর এসব সঙ্কট ও তালা খোলার একটি মাত্র চাবি, এটাকে মুক্তির মহাতন্ত্র, মূল চাবিকাঠি (গধংঃবত্ শবু) হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এ চাবিকাঠি আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলদের কাছে ছিল। একমাত্র তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কায়েমের মাধ্যমেই এটা অর্জিত হয়। এই চাবিকাঠি হচ্ছে, আল্লাহর মহান সত্তার প্রতি নিটোল বিশ্বাস এবং তাঁর ভয়। এই চাবিকাঠি দ্বারাই মানবিক জীবনের সব সমস্যা ও সঙ্কট অতি সহজে দূরীভূত হয় এবং জীবনের সব আবিলতা মুক্ত হয়। মনে করুন, পয়গাম্বরদের হাত বৈদ্যুতিক সুইচের ওপর। তারা ওই সুইচে টিপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘর আলোকিত হয়ে গেল। যাদের আঙুল ওই সুইচ পর্যন্ত পৌঁছবে না তারা ঘর আলোকিত করতে পারবে না।এদেশ স্বাধীন করতে আপনারা সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনা করেছেন, ত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, নেতাদের দেখানো পথে গমন করেছেন। ফলে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আপনাদের অর্জিত হয়েছে। এখন মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন করে আপনাদের চেষ্টা-সাধনা করতে হবে। প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের এটাই একমাত্র পথ। আর এটা ওই পথ যে পথের নির্দেশ করেছেন আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলরা, যে পথে গমন করে গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন অনুসারীরা। তারা দুনিয়াতে প্রকৃত মানুষের নমুনা প্রদর্শন করেছেন। এ পথের পাথেয় হচ্ছে ঈমান, একিন এবং খোদভীতি। প্রকৃত খোদাভীতি, তাজা ঈমান এবং জাগ্রত কলব নবী-রাসুলদের ছাড়া আর কোথাও মিলবে না। এটাই তাদের ভাণ্ডার, এ ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ করতে আমাদের কোনো লজ্জা-সংকোচ থাকা উচিত নয়। আজ যদি এসব গুণ অর্জন এবং প্রচার-প্রসারে আজাদি সংগ্রামের মতো ত্যাগ-তিতিক্ষার সূচনা হয়, উপনিবেশ বিতাড়নে যে সাধনা করা হয়েছে সে সাধনা যদি করা হয়, তবে দেশের চেহারাই ভিন্নরূপ ধারণ করবে। অর্জিত হবে প্রকৃত অর্থে শান্তি ও নিরাপত্তা। বন্ধ হবে দাসত্বের চলমান ধারা। দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা এবং জীবনের প্রকৃত স্বাদ তখনই হাসিল হবে।